অনিয়মের কারণে তারল্যসংকটে পড়েছিল এমন ছয় ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম সীমিত করার পাশাপাশি তাদের ঋণপত্র (এলসি) খোলার কার্যক্রমেও শতভাগ মার্জিন আরোপ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন ব্যাংক ছয়টির উন্নতির স্বার্থে ঋণপত্র খোলায় আগের শর্ত তুলে নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে ব্যাংকগুলো এখন চাহিদামতো আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারবে।
এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ইতিমধ্যে পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি তারল্যসংকট কাটাতে তাদের ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ধার দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক ছয়টি হলো ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ছয় ব্যাংকই একসময় এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ও নিয়ন্ত্রণে ছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক চিঠি দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বলেছে, আর্থিক ও ব্যবসায়িক অবস্থার উন্নতির স্বার্থে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে অন্য ব্যাংকগুলোকে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, তা মেনে চলতে হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তারা মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুযোগ দেওয়ার ফলে তাঁদের আমদানি ব্যবসা শুরু করা সম্ভব হবে। বেশির ভাগ গ্রাহক শতভাগ টাকা জমা দিয়ে আমদানি ব্যবসা করতে চান না। এ জন্য অনেক গ্রাহক অন্য ব্যাংকে চলে গেছেন। এখন ওই গ্রাহকেরা আবার ফিরে আসতে পারেন।
এই ছয় ব্যাংকই বহুল আলোচিত এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ২০১৬ সালের পর দখল করেছিল গ্রুপটি। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক আরও আগে থেকেই গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণে ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার এসব ব্যাংক থেকে লুট করতে সহায়তা করে। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। টাকা ছাপিয়ে লুট করার সুযোগ প্রদানও বন্ধ করা হয়। এতে অবশ্য টাকা তুলতে ব্যর্থ হন আমানতকারীরা। পরে নতুন সরকারও শুধু আমানতকারীদের স্বার্থে এসব ব্যাংককে টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়া শুরু করে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা দপ্তরের সাবেক কিছু কর্মকর্তা শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক দখল করতে সহায়তা করেছেন। এসব ব্যাংক দখল করে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১ হাজার ৬৭০ কোটি মার্কিন ডলার) বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নতুন শেয়ারধারীদের ঋণ দেওয়া ও আমদানির অতিরিক্ত খরচ দেখানোর মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, ‘যেকোনো বৈশ্বিক মানদণ্ডে এটি সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে ব্যাপক ব্যাংক ডাকাতি। এই মাত্রায় (ব্যাংক ডাকাতি) অন্য কোথাও হয়নি। এটি ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এবং গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িতরা (ব্যাংকের সাবেক প্রধান নির্বাহীদের) মাথায় বন্দুক না ঠেকালে এটা হতে পারত না।’
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় কয়েকটি ব্যাংক দখল করার পর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলমের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর সহযোগীরা ‘অন্তত’ ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ‘বের করে নিয়েছেন’। গভর্নরের মতে, ‘তাঁরা প্রতিদিনই নিজেদের জন্য ঋণ অনুমোদন করেছেন।’
সাইফুল আলমের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠান কুইন এমানুয়েল আরকুহার্ট অ্যান্ড সুলিভান একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে এস আলম গ্রুপ জানিয়েছে, গভর্নরের অভিযোগের ‘কোনো সত্যতা নেই’। এতে বলা হয়, ‘এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশের আরও কিছু শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের সমন্বিত প্রচারণা এমনকি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মৌলিক নীতির প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে।’