শেয়ারবাজারে সাবেক শিবলী কমিশনের সময়কালে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসা কারসাজিকারক আবুল খায়ের হিরু, তাঁর পরিবারের সদস্য ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার কারসাজির দায়ে ১৩৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সভায় এই জরিমানার সিদ্ধান্ত হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে বিএসইসি।
বিএসইসি জানায়, আবুল খায়ের, তাঁর পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের বাইরে আরও দুই ব্যক্তিকে শেয়ার কারসাজির দায়ে ৫০ লাখ টাকা, গ্রাহক হিসাবে অর্থ ঘাটতির দায়ে এক ব্রোকারেজ হাউসকে ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া শেয়ার কারসাজির আরেক ঘটনায় তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারধারী তিন পরিচালককে ২০ লাখ টাকা করে ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আবুল খায়ের হিরুসহ তাঁর পরিবারের বাইরের পাঁচ ব্যক্তি ও এক ব্রোকারেজ হাউসকে মোট ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সব মিলিয়ে বিএসইসির মঙ্গলবারের সভায় উল্লেখিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১৩৬ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়
বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, আবুল খায়ের হিরু, তাঁর বাবা আবুল কালাম মাতবর, স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বোন কণিকা আফরোজ, ভাই সাজেদ মাতবর ও মোহাম্মদ বাসার, শ্যালক কাজী ফুয়াদ হাসান ও কাজী ফরিদ হাসান, নিকটাত্মীয় আলেয়া বেগম এবং হিরুর সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান মোনাক হোল্ডিংস ও ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেডকে জরিমানা করা হয়েছে। তাদের জরিমানা করা হয় ২০২১ সালে বিভিন্ন সময়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফরচুন শুজ, ডেলটা লাইফ ইনস্যুরেন্স, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও সোনালী পেপারের শেয়ার নিয়ে কারসাজির দায়ে। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জরিমানার অঙ্ক ভিন্ন ভিন্ন। সব মিলিয়ে জরিমানার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে এককভাবে সর্বোচ্চ ৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে হিরুর বাবা আবুল কালাম মাতবরকে। হিরুকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৭ কোটি টাকা জরিমানা করা হয় তাঁর স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসানকে। এরপর হিরুর বোন কণিকা আফরোজকে প্রায় ২২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।
এ ছাড়া হিরুর সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান ডিআইটি কো-অপারেটিভকে প্রায় ১৬ কোটি টাকা, ভাই সাজেদ মাতবরকে ২ কোটি টাকা, আরেক ভাই মোহাম্মদ বাসারকে ১ কোটি ১৬ লাখ টাকা, শ্যালক ফুয়াদ হাসানকে ৩৬ লাখ টাকা ও ফরিদ হাসানকে ৩৫ লাখ টাকা, মোনাক হোল্ডিংসকে ৬ লাখ টাকা এবং আত্মীয় আলেয়া বেগমকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
মূলত হিরুই তাঁর পরিবারের বিভিন্ন সদস্য ও সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাবগুলোতে লেনদেন করতেন।
সোনালী পেপারের শেয়ারধারী তিন পরিচালককে প্যারামাউন্ট ইনস্যুরেন্সের শেয়ার লেনদেনে কারসাজির কারণে ২০ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। যাঁদের জরিমানা করা হয়েছে তাঁরা হলেন সোনালী পেপারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহফুজা ইউনুস ও পরিচালক মোহাম্মদ জাবেদ নোমান। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটির পাঁচ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে এই তিনজনই শেয়ারধারী পরিচালক।
অভিযোগ আছে, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলামের মেয়াদকালে শেয়ারবাজারে আলোচিত কারসাজিকারক ও অন্যতম সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলেন সোনালী পেপারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুস। এ ছাড়া আবুল খায়ের হিরু ও তাঁর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলামের আনুগত্য পেয়েছেন। এ কারণে ২০২১ সালে কারসাজির এসব ঘটনা উদ্ঘাটিত হলেও শিবলী কমিশন, অর্থাৎ বিএসইসির তৎকালীন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে রাখেন। ফলে কারসাজির মাধ্যমে কিছু শেয়ারের অস্বাভাবিক দাম বাড়িয়ে বড় অঙ্কের মুনাফা করেও শাস্তির বাইরে থেকে যান কারসাজিকারকেরা।
চলতি বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুনর্গঠন করা হয়। তাতে বিএসইসির শীর্ষ নেতৃত্বে আসেন সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি দায়িত্ব নিয়ে আগের কমিশনের ধামাচাপা দিয়ে রাখা কারসাজির বিভিন্ন ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। এসব ঘটনায় এরই মধ্যে একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়েছে। পুনর্গঠিত বিএসইসি বেক্সিমকোর শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনায় সবচেয়ে বড় জরিমানা করে। বেক্সিমকোর শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনায় গত অক্টোবরে চার ব্যক্তি ও পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে রেকর্ড ৪২৮ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়। এরপর বিএসইসির এক সভায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩৫ কোটি টাকা জরিমানা করা হয় আবুল খায়ের হিরু ও তাঁর পরিবারকে।