বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভারতীয় জ্বালানি সরবরাহকারী আদানি পাওয়ারের বিরুদ্ধে কোটি ডলারের চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে। এই চুক্তি অনুসারে, আদানি তাদের বিদ্যুৎ প্রকল্পে ভারতের কাছ থেকে প্রাপ্ত কর ছাড় সুবিধাগুলো বাংলাদেশকে দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের হাতে আসা নথি ও ছয় বাংলাদেশি কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারে এই তথ্য উঠে এসেছে।
২০১৭ সালে ভারতীয় ধনকুবের গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি পাওয়ার বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি কয়লা-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। তবে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও আদানির মধ্যকার চিঠিপত্র এবং সংশ্লিষ্ট নথি বিশ্লেষণে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোনও দরপত্র ছাড়াই অনুমোদিত এই চুক্তিটি বাংলাদেশের অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ চুক্তির তুলনায় অনেক ব্যয়বহুল।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে সরবরাহ শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ আদানি পাওয়ারকে পাওনা অর্থ পরিশোধে পিছিয়ে রয়েছে। আদানি পাওয়ার দাবি করেছে যে তাদের ৯০০ মিলিয়ন ডলার পাওনা, তবে বিপিডিবি বলছে, বকেয়া অর্থ ৬৫০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
কর ছাড় ও অর্থনৈতিক বিতর্ক
আদানি পাওয়ারের গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আমদানিকৃত কয়লার ওপর নির্ভরশীল এবং এটি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নির্মিত। ২০১৯ সালে ভারতের সরকার এই প্রকল্পকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে, যার ফলে প্রকল্পটি আয়কর এবং অন্যান্য কর থেকে অব্যাহতি পায়।
চুক্তি অনুযায়ী, আদানি পাওয়ারকে এই কর সুবিধার পরিবর্তন সম্পর্কে দ্রুত বাংলাদেশকে জানাতে এবং সুবিধাটি হস্তান্তর করতে বলা হয়েছিল। তবে বিপিডিবি থেকে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ও ২২ অক্টোবর পাঠানো চিঠিতে জানানো হয়, আদানি পাওয়ার এই সুবিধা প্রদান করেনি। বিপিডিবি কর্মকর্তাদের মতে, এই সুবিধাটি প্রদান করলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতে শূন্য দশমিক ৩৫ সেন্ট সাশ্রয় হতো, যা গত অর্থবছরে মোট ২৮.৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করতে পারত।
চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার আদানি চুক্তি পুনরায় মূল্যায়নের পরিকল্পনা করছে। সেপ্টেম্বর মাসে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল গঠন করে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি চুক্তিগুলো পর্যালোচনা শুরু করা হয়। পাশাপাশি একটি আদালত আদানি চুক্তির তদন্তের আদেশ দিয়েছে।
ড. ইউনূসের কাছে ১ ডিসেম্বর জমা দেওয়া একটি বিশেষ শ্বেতপত্রে হয়েছে, আদানির সঙ্গে চুক্তি ‘তাড়াহুড়ো করে’ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এতে চুক্তিটি পুনর্মূল্যায়নের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুতের উচ্চমূল্য ও বিতর্কিত শর্ত
২০১৭ সালের চুক্তিতে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল দুটি সূচকের গড়ের ওপর ভিত্তি করে। তবে বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, গড্ডা প্রকল্পের বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট খরচ বাংলাদেশের অন্যান্য ভারতীয় বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি।
অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ৯৭ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার পরেও আদানি পাওয়ার বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ অর্ধেক করে দেয়। এই ঘটনা বাংলাদেশকে ক্ষুব্ধ করেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, আদানির বিদ্যুৎ ছাড়াই দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা মেটাতে পারবে বাংলাদেশ। যদিও সব উৎপাদন ইউনিট চালু নেই। তিনি আরও বলেন, যদি তদন্তে দুর্নীতি বা অনিয়ম প্রমাণিত হয়, তাহলে আদালতের আদেশ মেনে চুক্তি বাতিলের প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
আদানি পাওয়ার অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, তারা চুক্তির সব শর্ত মেনে চলছে। তবে চুক্তির আর্থিক শর্ত নিয়ে আলোচনা করতে উভয় পক্ষ শিগগিরই বৈঠকে বসবে।