বুধবার, জানুয়ারি ১৫, ২০২৫
শিরোনাম:
Homeআর্ন্তজাতিকবাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লির এফসিসি-তে যে আলোচনা হলো

বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দিল্লির এফসিসি-তে যে আলোচনা হলো

- Advertisement -spot_img

এফসিসি বা ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাব অব সাউথ এশিয়া দিল্লির একটি আইকনিক প্রতিষ্ঠান। দক্ষিণ এশিয়াতে কর্মরত বিভিন্ন বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি বা সংবাদদাতাদের খুব পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ক্লাব এটি।

গত সপ্তাহে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়েই সেখানে একটি মনোজ্ঞ আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হলো হাইব্রিড ফরম্যাটে, যাতে অংশ নিয়েছিলেন ভারত, বাংলাদেশ, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও নেপাল থেকে আসা বিশেষজ্ঞরা। সামগ্রিকভাবে ভারতে পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কী ভাবছেন, তার একটি প্রতিফলন ছিল এফসিসি-র এই আলোচনাসভা।

আলোচনার সূচনা করে এফসিসি-র বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও বর্ষীয়ান সাংবাদিক এস ভেঙ্কট নারায়ণ। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে চলে আসা নিবিড় সম্পর্কের স্মৃতি রোমন্থন করেন।

 শুরুতেই দেখানো হয় ’৭২-র ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার ব্রিগেড ময়দানে শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর যৌথ জনসভার ফুটেজ – যেখানে শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণ সীমান্তের দু’পারের বাঙালিরই লোকগাথার অংশ হয়ে উঠেছিল।

সভার প্রথম বক্তা ভারতের সাবেক কূটনীতিবিদ তথা ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানকে একটি ‘ক্যু দেতা’র সঙ্গে তুলনা করেন এবং বলেন, ২০০৭ সালে যেভাবে একটি সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছিল তার সঙ্গে ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের বেশ মিল আছে, কারণ এখানেও ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে সামরিক নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন সমর্থনেই!

কিন্তু মিলের শেষ এখানেই – কারণ তার মতে ৫ অগাস্টের পর থেকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিগুলো লোপ করার চেষ্টা চলছে, কিংবা ভারতের সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্কের স্মারক, ঢাকাতে ইন্দিরা গান্ধীর নামাঙ্কিত আইসিসিআর ভবনকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছে, তা কিন্তু সেবার হয়নি।

‘আরও দুর্ভাগ্যের বিষয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা সেগুলোকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস পর্যন্ত বলছেন ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারীর পতনের পর এগুলো একটু-আধটু নাকি হবেই!’, বলেন তিনি।

আজকের বাংলাদেশে ‘ইসলামপন্থিদের উত্থানে’ ভারত যে উদ্বিগ্ন এবং ঢাকার একটি ‘অনির্বাচিত সরকারে’র সঙ্গে দিল্লি যে কখনোই ‘ফুল এনগেজমেন্টে’ যাবে না – সেটাও স্পষ্ট করে দেন পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক ওমর সেলিম শেরো আলোচনায় ভার্চুয়ালি যোগ দেন কানাডার টরন্টো থেকে। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ পরিচালনার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘গত চার-পাঁচ মাসে প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে, প্রোডাকশন হু হু করে কমছে। মবোক্রেসি আর চাঁদাবাজি চলছে লাগামহীনভাবে। অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে।’

শেখ হাসিনার আমলে অর্থনীতির হাল অনেক ভালো ছিল, এই দাবি করে তিনি আরও বলেন, বর্তমান সরকার বিগত জমানার অর্থনীতি নিয়ে যে হোয়াইট পেপার বা শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে সেটাকে তিনি ‘ইয়েলো পেপার’ (হলুদ সাংবাদিকতার তুলনা টেনে) বা ‘ব্ল্যাক পেপার’ বলেই মনে করেন!

তবে আওয়ামী লীগ আমলের কাজকর্মেরও সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সব সময় আত্মসমালোচনার কথা বলতেন, নিজের দোষত্রুটি দেখতে বলতেন। সেই আমলেও ভুলভ্রান্তি অবশ্যই কিছু হয়েছিল, না হলে তো এই আন্দোলনের জন্মই হত না!’ কিন্তু আজকের বাংলাদেশ যে ক্রমশ একটি ‘তালেবান ধাঁচের সরকারে’র কব্জায় চলে যাচ্ছে, এই আক্ষেপও ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে।

লন্ডন থেকে আলোচনায় যোগ দিয়ে সেখানকার বাংলা টিভি চ্যানেলের সুপরিচিত প্রেজেন্টার উর্মি মাজহার আবৃত্তি করেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিখ্যাত কবিতা ‘ওরা তিরিশ লক্ষ’!

কবিতা পড়ছেন উর্মি মাজহার

উর্মি মাজহারের আর একটি পরিচয়, তিনি বিখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ছোট বোন। আলোচনায় উর্মি এদিন কোনও ভাষণ দেননি, ভরসা রেখেছিলেন শুধু কবিতার ভাষাতেই।

এদিনের আলোচনায় ভারতের ভূমিকা নিয়ে সবচেয়ে আক্রমণাত্মক ছিলেন বাংলাদেশ মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট মহসিন রশিদ। ঢাকা থেকে অনলাইনে আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতের জন্যই বহু বহু বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ কোনও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন পায়নি। ভারতের প্রণব মুখার্জি বা সুজাতা সিং-রা বাংলাদেশে কী ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন আমরা সবাই জানি, এভাবেই আমাদের নির্বাচনগুলো ম্যানিপুলেট করা হয়েছে, আমাদের গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।’

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এই মুহুর্তে আবার ‘রিসেট’ করার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আগরতলায় আমাদের দূতাবাস আক্রান্ত হচ্ছে, দিল্লিতে আমাদের মিশন অভিমুখে হিন্দুত্ববাদীরা মিছিল করে যাচ্ছে, কিংবা রিপাবলিক টিভি আর অর্ণব গোস্বামী তাদের চ্যানেলে লাগাতার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে যাচ্ছে, এভাবে তো সম্পর্ক চলতে পারে না!’ দুদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে দু’পক্ষকেই ‘রেটোরিক’ বা বাগাড়ম্বর দেখানোর ক্ষেত্রে সংযত হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মুসলীম লীগ নেতা মহসিন রশিদ আরও বলেন, ভারত যদি সত্যিই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়, তাহলে দিল্লির উচিত হবে উদারতা দেখিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ চালু করা। ভারতের ভিসার আবেদন করার সময় আবেদনকারী আগে কখনও পাকিস্তানে গেছেন কি না, তা পরীক্ষা করার জন্য তার পুরনো সব পাসপোর্ট জমা দেওয়ার যে নিয়ম আছে, সেটাও বাতিল করার দাবি জানান তিনি।

মহসিন রশিদ

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি একাধিকবার দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বা ‘সার্ক’কে পুনরুজ্জীবিত করার কথা বলেছেন, সেই দাবিতেও জোরালো সমর্থন জানান মহসিন রশিদ। তিনি বলেন, ‘সার্ক শুধু ভারতের জেদের কারণে অচল ও স্থবির হয়ে পড়ে আছে। অথচ আমাদের এই অঞ্চলে আঞ্চলিক সহযোগিতার একটি প্ল্যাটফর্ম খুবই দরকার, যে কারণে সার্ককে জিইয়ে তোলাটা জরুরি!’

নেপালের পার্লামেন্টারিয়ান হরিচরণ শাহ বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে একটি চমকপ্রদ সাদৃশ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমাদের মতোই বাংলাদেশও ভৌগোলিকভাবে তিন দিক দিয়ে ভারত দিয়ে ঘেরা। ফলে আমরা চাই বা না-চাই, ভারতের সঙ্গে আমাদের উভয় দেশেরই একটা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রাখাটা অত্যন্ত প্রয়োজন।’

এমন কী, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই দুই দেশেরই ভারতের ‘অভিভাবকত্ব’ (গার্জিয়ানশিপ) মেনে নিলে তা আখেরে উভয়েরই কাজে আসবে – এমন একটি ‘বিতর্কিত’ মন্তব্যও করেন নেপালের ওই রাজনীতিবিদ।

বাংলাদেশ-বিশেষজ্ঞ তথা বিবিসির সাবেক সংবাদদাতা সুবীর ভৌমিক কলকাতা থেকে আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, “আগ্রাসী ‘পশ্চারিং’ করে ভারত বা বাংলাদেশ কোনও পক্ষেরই কোনও লাভ হবে না। বাংলাদেশের যে সাবেক সেনা কর্মকর্তারা হুমকি দিচ্ছেন চার দিনে কলকাতা বা আগরতলা দখল করে নেবেন, তাদের বলব সত্যিই যুদ্ধ করার শখ থাকলে বরং আপনাদের মিয়ানমার সীমান্তে যান, ওখানে আরাকান আর্মি মর্টার ছুঁড়ছে!”

এফসিসি-র ইভেন্টের একটি পোস্টার 

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আপনারা তো নির্বাচিত সরকারও নন, দেশের সংস্কার সাধনের কোনও ম্যান্ডেটও আপনাদের নেই – তারপরও আপনারা কীসের ভিত্তিতে দেশের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে চাইছেন বা সংবিধানে বদল আনছেন?’ স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি যে চেতনার ওপর গড়ে উঠেছে, সেই ১৯৭১র ‘লিগ্যাসি’ অস্বীকার করতে চাইছে ঢাকার বর্তমান সরকার, এমন অভিযোগও আনেন তিনি।

সুবীর ভৌমিক আরও বলেন, আজকের বাংলাদেশ একটি ‘ভেন্ডেটা রিপাবলিক’ বা ‘প্রতিহিংসার প্রজাতন্ত্রে’ পরিণত হয়েছে এবং তার জেরে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। ‘স্টেট স্পন্সর্ড রেট্রিবিউশন – মানে রাষ্ট্রীয় মদতে প্রতিশোধের রাজনীতি চালানো হলে সে জাতির কখনও মঙ্গল হতে পারে না, অথচ এখন বাংলাদেশে ঠিক সেটিই ঘটছে’, বলেন তিনি।

আলোচনাসভার শেষ বক্তা ছিলেন দিল্লিতে ভারতের জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও দীর্ঘদিনের বাংলাদেশ পর্যবেক্ষক গৌতম লাহিড়ী।

বাংলাদেশের হিন্দু বা সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ইদানিং কালে যে একজোট হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সে প্রসঙ্গে প্রবীণ এই সাংবাদিক বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী আছেন। এতদিন তারা নির্যাতিত হলেই ভারতে চলে আসার কথা ভাবতেন, কিন্তু এখন সেই ভাবনার নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে।’

‘এখন আমরা দেখছি এই হিন্দুদের মধ্যে বিরাট কনসলিডেশন হয়েছে। তারা জোট বেঁধেছেন এবং নিজেদের নাগরিক অধিকার আদায়ের জন্য লড়ছেন। তারা এখন বলছেন কেন আমরা সীমান্ত পেরোতে যাব? বাংলাদেশেই থাকব, কারণ এটা আমাদেরও দেশ!’, বলেন তিনি। সে দেশের হিন্দুদের মানসিকতায় এই পরিবর্তনকে খুবই ইঙ্গিতবাহী বলে বর্ণনা করেন গৌতম লাহিড়ী।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img
সর্বশেষ সংবাদ
- Advertisement -spot_img
এই বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- Advertisement -spot_img

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here