ইংলিশ কোচ জেমি ডের সময় বাংলাদেশ দল রক্ষণ সামলে প্রতি আক্রম নির্ভর খেলেছে। তার জায়গায় স্প্যানিশ কোচ হাভিয়ের কাবরেরা এসে অন্তত দলের মধ্যে জয়ের মানসিকতা তৈরি করেছেন। রিয়াল মাদ্রিদে যখন কার্লোস আনচেলত্তি ৪-৪-২ ডায়মন্ড ছকে খেলিয়েছেন। ঠিক সেভাবে লাল-সবুজ দলকে তিন বছর ধরে মাঠে রেখেছেন। খুব যে সফল হয়েছেন তা বলা যাবে না।
পরিসংখ্যান বলছে হাভিয়ের কাবরেরার অধীনে বাংলাদেশ দল তিন বছরে ২৯টি ম্যাচ খেলেছে। জিতেছে ৮টিতে, ড্র ৬টি ও হার ১৫টি। এমন পরিসংখ্যানের তাকালে সব চিত্র ফুটে উঠবে না। তবে জামাল-তপুদের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা দেখা গেছে। প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লড়াই করার মানসিকতা অর্জন করেছে সবাই। বিশেষ করে দেশের মাঠে। ঠিক এই অবস্থায় ৩১ ডিসেম্বর ৪০ বছর বয়সী কোচের সঙ্গে চুক্তি শেষ হতে যাচ্ছে। উয়েফা প্রো লাইসেন্সধারী কোচ আশায় আছেন চুক্তি নবায়ন হবে। নতুন বছরে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। ক্রিসমাস উদযাপন করতে স্পেনে আছেন কাবরেরা। সেখান থেকে বাংলা ট্রিবিউনকে চুক্তির মেয়াদ ছাড়াও বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে নানান প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।
আপনার তিন বছর কেমন গেলো?
সামগ্রিকভাবে এই ৩ বছর দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রথম বছর থেকে দেশের প্রেক্ষাপট এবং ফুটবল সংস্কৃতি বোঝার ওপর বেশি মনোযোগী ছিলাম। অত্যন্ত সফল দ্বিতীয় বছর, যেখানে আমরা কেবল দুর্দান্ত ফলাফল অর্জনই করিনি বরং একটি ফুটবল পরিচিতি এবং ধরন ও তৈরি করেছি যা দেশকে তাদের জাতীয় দল নিয়ে গর্বিত করেছে।
নতুন করে কী ভাবছেন?
আমরা জানতাম যে ২০২৩ সালে আমরা যা অর্জন করেছি তাতে আমরা একটি চ্যালেঞ্জিং ২০২৪ এর মধ্য দিয়ে যাবো, খুব শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হবো যা ইতিবাচক ফলাফল অর্জন করা কঠিন করে তুলবে, তবে আমাদের আরও বেশি প্রতিযোগী এবং পরিণত দল বানাবে। আমরা এখন সেটার জন্য প্রস্তুত। ২০২৫ বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর।
আপনি যখন লিগ থেকে প্রথমবারের মতো একজন খেলোয়াড়কে বাছাই করেন এবং তাকে জাতীয় দলে আনেন, তখন সেই নির্দিষ্ট খেলোয়াড়ের জন্য আপনাকে কতটা কাজ করতে হয়?
জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারে এমন একজন খেলোয়াড়ের মধ্যে আমরা কী দেখতে চাই সে বিষয়ে আমরা খুবই কঠোর এবং সতর্ক। আমাদের জন্য, প্রযুক্তিগত – কৌশলগত মান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এর কোনও মূল্য নেই যদি আমরা জাতীয় দলের হয়ে খেলার আবেগ, প্রতিশ্রুতি এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখতে না পাই এবং এটিকে পরবর্তী স্তরে নিয়ে না যাই। বাংলাদেশের হয়ে খেলতে হবে অনন্য কিছু এবং আমাদের এমন খেলোয়াড় দরকার যারা ব্যক্তিগতভাবে দলের সাফল্যকে প্রাধান্য দেয়। এই সংস্কৃতি তৈরি করা, এই বার্তা প্রেরণ করা, যখন কেউ প্রথমবারের মতো দলে যোগ দেয় তখন সেটাই গুরুত্ব পাবে। এটা খুব পরিষ্কার হতে হবে, মানসিকতা আমাদের দলের সবকিছু। প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত অংশটি আমার দায়িত্ব এবং আমি নিশ্চিত করবো যেন তারা আমাদের অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের খেলার ধরন এবং নীতিগুলি বোঝে।
আমি আগেই বলেছি, সবকিছুর আগে জয়ের মানসিকতা, অঙ্গীকার এবং মনোভাব থাকতে হবে। যদি আমাদের এটা থাকে, আমরা পারফর্ম করে গেম জিততে পারবো। এটাই আগে, ট্যাকটিকস আপনাআপনি হবে।
আপনি নিয়মিত প্রিমিয়ার লিগ দেখে থাকেন। এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে ছুটে যান। বাংলাদেশ ঘরোয়া লিগ সম্পর্কে আপনার পছন্দ ও অপছন্দের একটি জিনিস কী?
আমাদের একটি নিয়মিত প্রতিযোগিতা ব্যবস্থা (বিপিএল এবং ফেড কাপ) থাকার বিষয়ে ইতিবাচক হতে হবে যাতে প্রতি বছর ধারাবাহিকতা থাকে, এটি যেকোনো খেলাধুলার বিকাশ এবং জাতীয় দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, আমাদের ভালো মানের ফুটবল মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে যা বাংলাদেশের প্রতিভাকে ঠিকমতো বিকাশের সুযোগ দেবে, পাশাপাশি মানও বাড়াবে। তাতেই তো সমর্থকদের ক্লাবগুলির কাছাকাছি নিয়ে আসবে। বাংলাদেশের মানুষের ফুটবলের প্রতি যে বিপুল আবেগ আছে, তা আমরা জাতীয় দলের ম্যাচগুলোতে দেখতে পাই। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় আমাদের একই পরিবেশ দেখতে হবে। স্টেডিয়ামে আমাদের আরও লোক দরকার।
আমি আত্মবিশ্বাসী যে আমাদের নতুন সভাপতির সঙ্গে আমরা লিগের মানের একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাবো।
বাংলাদেশি ফুটবল সংস্কৃতি সম্পর্কে আপনার কেমন ধারণা হয়েছে- ফুটবলার থেকে ভক্ত, মিডিয়া পর্যন্ত…
আমি জাতীয় দলের চারপাশে আবেগ এবং উত্তেজনা পছন্দ করি। আগেই বলেছি, বাংলাদেশে ফুটবল খুবই বিশেষ কিছু। রয়েছে বিশাল আবেগ ও ঐতিহ্য। জাতীয় দল যখন খেলে মিডিয়ার কভারেজের মাত্রা দেখলে পরিষ্কার, অবশ্যই তা ফুটবলের প্রতি এই ভালোবাসার একটি বড় লক্ষণ।
এছাড়া জাতীয় দলের হয়ে খেলার সময় আমাদের খেলোয়াড়দের মনোভাব এবং মানসিকতা খুবই অন্যরকম থাকে, খেলার ৯০ মিনিট জুড়ে সমর্থকরা যেভাবে দলকে সমর্থন করে তা বিস্ময়কর, শুধু ঘরেই নয়। আমরা ঘরের বাইরে যে গেমগুলি খেলি তাতে আমরা যে সমর্থন পাই, এটি সত্যিই অনন্য কিছু, আমার মনে হয় না বিশ্বের অন্য কোনও দেশ দূরে খেলার সময় এই সমর্থন পায়।
২০২৪ সালে আমাদের অনুশোচনাগুলোর মধ্যে একটি হলো কুয়েতে ফিলিস্তিন এবং দোহাতে লেবাননের কাছে হার। সেই দুটি ম্যাচে আমাদের ভালো হয়নি। সেখানে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি সমর্থক উপস্থিত ছিলেন এবং তাদেত ইতিবাচক কিছু প্রাপ্য। আমরা ২০২৫ সালে তাদের ফিরিয়ে দেবো।
বাংলাদেশ দল আপনার অধীনে ৪-৪-২ ছকে খেলে থাকে। যদি একজন যোগ্য স্ট্রাইকার পেতেন তাহলে অন্য রূপে দেখা যেতো লাল-সবুজ দলকে?
আগেই বলেছি, সবকিছুই জয়ের মানসিকতা, প্রতিশ্রুতি এবং মনোভাব নিয়ে। যদি আমাদের এটা (নাম্বার নাইন) থাকে, আমরা আরও পারফর্ম করতে পারবো এবং ম্যাচ জিততে পারবো। এছাড়া ম্যাচ ও কৌশল অনুযায়ী সমন্বয় করা হবে।
জাতীয় দল নিয়ে কাজ করছেন তিন বছর হলো। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
আমি সবসময় বলেছি যে আমি ইতিমধ্যে ৩ বছর ধরে বাংলাদেশের জাতীয় প্রধান কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পেরে খুবই গর্বিত এবং আনন্দিত।
আপনার চুক্তি শেষ হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর। কী ভাবছেন? চুক্তি নবায়ন হবে?
আমি সবসময় বলে আসছি বাংলাদেশ দলে কাজ করতে পেরে সবসময় গর্বিত ও আনন্দিত। এই দলকে কিছু দিতে পেরেও। আমি নিশ্চিত যে আমরা সঠিক পথে যাচ্ছি এবং অদূর ভবিষ্যতে অনেক ইতিবাচক জিনিস আসতে চলেছে।
ইংলিশ লিগে লেস্টার সিটিতে খেলা ফুটবলার হামজা চৌধুরী বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন। এটা তো আনন্দের খবর। আপনি কী ভাবছেন?
বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে হামজার খেলা নিশ্চিত হওয়া খুবই ভালো খবর। সে কেবল তার টেকনিক্যাল গুণের কারণেই নয়, তার পেশাদারিত্ব, বিজয়ের মানসিকতা এবং নেতৃত্বের কারণে দলকে অনেক ইতিবাচক ব্যাপার এনে দেবে। বাফুফে একটি চমৎকার কাজ করেছে, তাকে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের জন্য আনতে পারা দলের জন্য একটি দারুণ অনুপ্রেরণার ব্যাপার হবে।