গ্রামে শীতলপাটি ও হাতপাখার কদর এখনো আছে। এখনো বিয়েতে কনের সঙ্গে এ দুটি দরকারি জিনিস দেন অনেকেই। আর শীতলপাটি, হাতপাখা ও বসার জন্য মোড়ার দরকার হলেই খোঁজ পড়ে ফুলতেরা বেগমের। কেউ কেউ আগেই বলে রাখেন। আবার কেউ বাড়িতে এসে এসব পণ্য কিনে নিয়ে যান।
প্রায় কুড়ি বছর ধরে বাঁশ–বেত দিয়ে বাড়িতে এসব পণ্য তৈরি ও বিক্রি করছেন ফুলতেরা। এ কাজে তাঁর মূল সহযোগী একমাত্র মেয়ে আছুমা বেগম। কিন্তু গ্রামীণফোনের ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ প্রচারাভিযানের আওতায় আয়োজিত উঠান বৈঠকে অংশ নেওয়ার পর নিজের ব্যবসা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন ফুলতেরা। তিনি বলেন, ‘ইটা (ইন্টারনেট) দিয়া তো অখলের জানানি সোজা (সহজ)। মানুষে বাড়িত বইয়া আমার জিনিস দেখিলিবা, পছন্দ করবা, দরকার অইলে কিনবা। আমি টেখাও পাইলাইমু ঘরও বইয়া।’
সুনামগঞ্জের সাতটি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নে নারীদের নিয়ে উঠান বৈঠক শেষ হয়েছে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর।
ফুলতেরা বেগমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিনি তাঁর তৈরি করা নানা পণ্য বিক্রি করেন গ্রামের হাটে। নিজে গ্রামের বিভিন্নজনের বাড়ি কিংবা গ্রামের হাট থেকে মুর্তা বা বেত কেনেন। পরে সেগুলোকে বেত হিসেবে তৈরি করেন, রং করেন। এরপর মা ও মেয়ে মিলে পাটি বানান। তিন ধরনের পাটি বানান তাঁরা। বিছানার, নামাজ পড়ার এবং বসার জন্য। বড় একটি পাটি বানাতে সপ্তাহখানেক সময় লেগে যায়। ২০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত একেকটি পাটি বিক্রি হয়। তবে নকশা করা পাটির দাম একটু বেশি। এ ছাড়া দিনে তিন থেকে চারটা হাতপাখা বানাতে পারেন। হাতপাখা বিক্রি হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকায়। বাঁশ দিয়ে ঝুড়ি ও মাছ ধরার চাঁইও বানান তাঁরা। অনেকেই বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানের আগে পাটি, পাখা ইত্যাদির জন্য ফোনে অর্ডার দিয়ে রাখেন।
পাশে থাকা মেয়ে আছুমা বেগম জানালেন, তিনি যখন ছোট, তখন বাবা ইনতাজ মিয়া মারা যান। এরপর মেয়েকে নিয়ে অকুল সাগরে ভাসেন মা। একপর্যায়ে পাটি বানানো শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে অন্য পণ্যগুলোও যুক্ত হয়। এখন এসব বিক্রির আয়েই মা-মেয়ের সংসার চলে।
উঠান বৈঠকে প্রদর্শিত ইন্টারনেট ব্যবহারে নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার গল্পে অনুপ্রাণিত হন মা ফুলতেরা ও মেয়ে আছুমা। আছুমা বেগমের একটি স্মার্টফোন আছে। এখন সেটাকে ব্যবসার কাজে লাগাতে চান তাঁরা। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাঁদের কাজগুলো ছড়িয়ে দিয়ে ব্যবসাকে বড় করার স্বপ্ন দেখছেন মা-মেয়ে। আছুমা বলেন, ‘আসলে বিক্রি বাড়াতে অইব। এর লাগি মানুষরে জানাইত অইব। মোবাইলে সবাইরে জানানোর ব্যবস্থা করব।’
লক্ষ্মীবাউর গ্রামের বাসিন্দা রোশনা বেগমের উঠানে অনুষ্ঠিত হয় বৈঠকটি। তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য। উঠান বৈঠকে অংশ নিয়ে রোশনা বেগম বলেন, ‘এই বৈঠক বেশ উপকার দেবে গ্রামীণ নারীদের। তাঁরা এখানে অনেক আশার গল্প শুনেছেন, দেখছেন। আশা করি এসব গল্প তাঁদের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।’
গ্রামীণ নারীদের জীবনে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে ‘ইন্টারনেটের দুনিয়া সবার’ কার্যক্রমটি। মানুষের নানাবিধ চাহিদা ও প্রয়োজন মেটাতে ইন্টারনেট যে সক্ষম, বিষয়টি প্রান্তিক নারীদের সরাসরি শেখাতেই এ আয়োজন। গ্রামীণফোনের উদ্যোগে আয়োজনটির সহযোগিতায় রয়েছে প্রথম আলো, নকিয়া ও ঢাকা ব্যাংক পিএলসি। ২০২৩ সালের মার্চে শুরু হওয়া কার্যক্রমটির আওতায় ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৪৯টি ইউনিয়নে সম্পন্ন হয়েছে উঠান বৈঠক।