লুইসি আলেইন নামের এক শিক্ষার্থী, যিনি সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্র্যানাডাইনস কমিউনিটি কলেজে পড়াশোনা করছেন। গ্লেন রোড, ক্যালিয়াকুয়াতে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি মাঠে বসে দেখেছিলেন তিনি, সাপোর্টও দিয়েছিলেন টাইগারদের। সহজ ম্যাচটি জিততে না পারায় বাংলাদেশের সমর্থকদের মতো হতাশ ছিলেন লুইসিও। তবে এবার নিজের দেশের বিপক্ষে আর্নোস ভেলেতে বাংলাদেশের দাপট দেখে কিছুটা মন খারাপ হলেও টাইগার ভক্ত হিসেবে উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারলেন না এই শিক্ষার্থী। যদিও তার প্রত্যাশা শেষ ম্যাচটিতে তার দেশই জিতবে।
গত বিশ্বকাপে তিন ম্যাচের দুটিতে জিতলেও আফগানিস্তানের বিপক্ষে আর্নোস ভেলেতে হেরেছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। তবে চলমান সিরিজে বাংলাদেশকে দুই হাত ভরেই দিয়েছে কিংসটাউনের ভেন্যুটি। টানা দুই ম্যাচ জিতে এখন শেষটা রাঙানোর স্বপ্নে বিভোর সফরকারীরা। শুধু সিরিজের শেষটাই নয়, চলতি বছরে বাংলাদেশের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটিও আজ (শুক্রবার) সকালে অনুষ্ঠিত হবে। বছরের শুরুটা ছিল ভীষণ হতাশাজনক। সেই হতাশা ভুলে শেষটায় এসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করতে পারলে বাংলাদেশের জন্য সেটি হবে তৃপ্তির।
কিংসটাউনের কন্ডিশন অনেকটা বাংলাদেশের মতো হলেও এখানে স্বাগতিক দর্শকদের বিপক্ষে নিয়মিত লড়তে হচ্ছে বাংলাদেশ দলকে! ক্যারিবীয়রা এমনিতেই আমুদে জাতি। দুঃখ-কষ্ট-হতাশা তাদের বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারে না। সব ভুলে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকাই তাদের জীবনের ধর্ম! কিংসটাইনে প্রথম ম্যাচে ছুটির দিন থাকায় গ্যালারি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। দ্বিতীয় ম্যাচে পুরো গ্যালারি ভর্তি না হলেও বেশিরভাগ আসনই ছিল ভরা। দুই ম্যাচেই দেখা গেছে সমর্থকদের গ্যালারি মাতিয়ে রাখতে। ডাক-ঢোল, ভুভুজেলা শব্দে কানে তালা লাগার অবস্থা। দলের পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, গ্যালারিতে ক্যারিবীয় সমর্থকদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস চলবেই।
কথা হয় ক্যারিবীয় এক সমর্থক ফ্লেচারের সঙ্গে। তোমরা এতো এনার্জি পাও কোথা থেকে? প্রশ্ন শুনে মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। এরপর উত্তর এলো, ‘আমরা জাতিগতভাবেই এমনই। আমাদের কোনও কষ্ট নেই, আমরা আনন্দ করতে ভালোবাসি। জীবনটা ছোট, তাই পুরো সমটাই উপভোগ করতে হবে। হ্যাঁ, দল খারাপ করছে, কিন্তু খেলা তো শুধুই একটা বিনোদন। এটা জীবনের অংশ মাত্র। এর জন্য তো নিজের আনন্দ নষ্ট করা যাবে না।’
এদিকে কিংসটাউনের আর্নোস ভেলে স্টেডিয়ামের বিশেষত্ব বিশেষ একটি গ্যালারিতে। প্রেসবক্সের বাঁ পাশে পার্টি স্ট্যান্ড নামে একটি গ্যালারি আছে। যার বাংলাদেশের গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের মতো ভিআইপিদের জন্য। এই স্ট্যান্ডে রয়েছে তিনটি ছোট সুইমিংপুল। খেলা দেখতে দেখতে চাইলেই যে কেউ গোসলে নামতে পারবেন। করতে পারবেন খাওয়া-দাওয়া। চেয়ার থাকলেও সবাই সবুজ গালিচাতে বসেই খেলা উপভোগ করেন। সাধারণত গ্যালারিতে যেমন উল্লাস দেখা যায়, তার চেয়ে বেশি দেখা যায় এই ভিআইপি পার্টি স্ট্যান্ডে। এখানে নানা সাজে, নানা ঢংয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের ভিআইপিরা বসেন। ভিনসেন্ট ও গ্র্যানাডাইনস দ্বীপপুঞ্জের প্রধানমন্ত্রী রাল্ফ এভেরার্ড গনসালভও দুটি ম্যাচই এখানে বসে দেখেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ২০০১ সালে থেকে দায়িত্ব নেন ৭৮ বছর এই বয়সী ব্যক্তি। দ্বীপটির বাসিন্দা অন্য সবার মতোই বেশ আমুদে প্রকৃতির তিনিও।
সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে ভিআইপি পর্যন্ত-সবাই খেলাটাকে কেবল উপভোগ করতে মুখিয়ে থাকেন। তবুও দিনশেষে দেশের হারে কষ্ট লাগাটাও স্বাভাবিক। বাংলাদেশ দল কী পারবে, ওয়ানডে সিরিজের প্রতিশোধ টি-টোয়েন্টিতে নিয়ে আমুদে জাতিকে কিছুটা হলেও কষ্টে ফেলতে?
২০২৪ সালের শুরুটা বাংলাদেশ করেছিলে বাজেভাবে। এই বছর ৪২ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র ১৭ ম্যাচ, হেরেছে ২৫টি। অথচ আগের বছর ৫০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ ২৪টি ম্যাচ জিতেছিল, হেরেছিলো ২২ ম্যাচে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বছরে সবচেয়ে বেশি ২৩ ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ কুড়ি ওভারের ক্রিকেটে। যেখানে ১১ জয়ের বিপরীতে পরাজয় ১২টি। আজ শেষ ম্যাচটি যদি বাংলাদেশ জিততে পারে, তাহলেও ১২-১২ ব্যবধান নিয়ে বাড়ি ফেরা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের প্রধান কোচ ফিল সিমন্স অবশ্য শেষ ম্যাচটি জিতে হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে মুখিয়ে আছেন, ‘হোয়াইটওয়াশ করতে পারব কী না জানি না; সিরিজ জিতেছি, এটাই বড় বিষয়। শেষ ম্যাচ তো অবশ্যই জিততে চাইবো। জয় দিয়ে সিরিজ শেষ করতে চাই, হাসিখুশি হয়ে বাড়ি ফিরতে চাই। ছেলেরা কোন দলের বিপক্ষে খেলছে সেটা বড় বিষয় নয়, তারা জানে তাদের করণীয় কী।’
ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে শেষ মিশনে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে দলে। নিয়মিত খেলা তিন পেসার হাসান মাহমুদ, তানজিম হাসান সাকিব ও তাসকিন আহমেদের মধ্যে দুই জন কিংবা একজনকে বিশ্রাম দেওয়া হতে পারে। সেক্ষেত্রে নাহিদ রানা কিংবা রিপন মণ্ডলের অভিষেক হয়েও যেতে পারে। তবে ব্যাটিংয়ে একটি পরিবর্তন প্রায় নিশ্চিত। ইনজুরিতে দল থেকে ছিটকে যাওয়া সৌম্য সরকারের পরিবর্তে ওপেনিংয়ে দেখা যেতে পারে পারভেজ হোসেন ইমনকে। একাদশে বদল এলেও বাংলাদেশের ভাবনাতে নিশ্চিতভাবেই বদল আসছে না! শেষটা জয় দিয়ে রাঙিয়েই যে দেশে ফিরতে চান ক্রিকেটারর!
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৪৮ দ্বিপক্ষীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলেছে। যার মধ্যে পাঁচবার প্রতিপক্ষকে হোয়াইটওয়াশ করেছে। সেই তালিকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ যোগ হবে কিনা তা দেখার অপেক্ষায় কোটি সমর্থক। পাশাপাশি বছরের শেষটা জয়ে রাঙাতে পারলে আত্মবিশ্বাসে কিছুটা জ্বালানি পাবে বাংলাদেশ। নতুন বছরে, নতুন মিশনে সেই আত্মবিশ্বাস নিশ্চিতভাবেই কাজে লাগবে।