কুইন্সের লাগার্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে আমাদের লম্বা সময়ের ফ্লাইটে যেতে হবে ক্যারিবিয়ান দ্বীপ সেন্ট ভিনসেন্টে। খুবই অস্বস্তিকর জার্নি শেষে সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড দ্য গ্র্যানাডাইনসের বিমানবন্দরে পৌঁছাতেই স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। ইমিগ্রেশন অফিসারের হাসিমুখ দেখে মন প্রফুল্ল হয়ে গেলো! তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো– ‘ভেবো না, এখানে বাংলাদেশ জিতবে!’
ভোর ছয়টায় ফ্লাইট। নিউইয়র্ক থেকে সেন্ট ভিনসেন্টে যাওয়ার ট্রানজিট আছে মায়ামিতে। ভোরে ফ্লাইট। তাই নির্ঘুম রাত কাটলো। নিউইয়র্কের ফার রকওয়ে থেকে কুইন্সের লাগার্ডিয়া বিমানবন্দর খানিকটা দূরে। মোহাম্মদ হোসেন মামুন ভাই কিছুটা আগেভাগেই আমাদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দিলেন। আমি ও আমার আরেক সহকর্মী জ্যোতির্ময় মন্ডল ৫টার আগেই পৌঁছৈ যাই বিমানবন্দরে। ওখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে করতে প্রায় ছয়টাই বেজে যায়। নিজের নির্ধারিত চেয়ারে বসতে বসতে রাজ্যের ঘুম নেমে এলো। চোখ খোলার কিছুক্ষণ পর কানে ভেসে এলো, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমানটি অবতরণ করবে, আমেরিকান এয়ারলাইন্সকে বেছে নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ…।’
স্থানীয় সময় সকাল নয়টায় মায়ামিতে পৌঁছায় বিমানটি। আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। বিমান থেকে বের হতে হতেই কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে। দশটায় সেন্ট ভিনসেন্টের ফ্লাইট ধরতে হবে আমাদের। অনেকটা দৌঁড়েই চেক-ইনের নির্ধারিত গেট খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলো। শুরু হলো অস্বস্তিকর ফ্লাইট! বিমানের শেষ সিটে জায়গা হলো আমার। উইন্ডো সিট পাওয়াতে যা একটু স্বস্তি। মেঘকে কেটে কেটে বিমান উড়ে যাচ্ছে সেন্ট ভিনসেন্টের দিকে। লম্বা জার্নিতে একদমই ভালো লাগছিল না। তবুও সাদা মেঘের ফাঁক গলে কখনও কখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দ্বীপগুলো উঁকি দিচ্ছিল। এইসব দৃশ্য লম্বা জার্নির অস্বস্তি ভুলিয়ে দিলো।
সেন্ট ভিনসেন্টের বিমানবন্দরে পৌঁছানোর আগ মুহূর্তের দৃশ্য আমার জীবনের সেরা স্মৃতি হয়ে থাকবে। ভিনসেন্টের সৌন্দর্য চোখে লেগে থাকবে অনেক দিন। ক্যারাবিয়ান সাগরে ৪৫ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩০টি দ্বীপ নিয়ে সেন্ট ভিনসেন্ট। মূলত সেন্ট ভিনসেন্ট ৩০টি দ্বীপের একটি। বাকি ২৯টি ছোট দ্বীপ আছে এখানে। মোট ৩০টি দ্বীপ নিয়ে সেন্ট ভিনসেন্ট অ্যান্ড গ্রেনাডাইন্স। এর রাজধানী হলো কিংসটাউন। আকাশ থেকে এসব নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে করতেই আমাদের বিমানটি মাটি ছুঁয়ে ফেললো।
এবার ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া শেষ করার পালা। ছোট বিমানবন্দরে যাত্রী খুব বেশি নয়। স্থানীয়দের এক লাইন আর বিদেশি পর্যটকদের আরেক লাইন। বিদেশি লাইনে আমেরিকান, পুর্তগিজ, ইতালিদের আধিক্য ছিল বেশি। লাইনে দাঁড়িয়ে আমাদের দুই বাংলাদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেলো ভারতীয় এক দম্পতির। তাদের সঙ্গে আলাপ করতে করতেই ইমিগ্রেশনের সময় হয়ে এলো। পাসপোর্ট হাতে নিতেই অফিসার বললেন, ‘ব্যাড লাক! সেন্ট কিটসে একটা ম্যাচও জিততে পারলে না তোমরা। তবে সেন্ট ভিনসেন্টে ভালো করবে বাংলাদেশ।’ শুভকামনা জানিয়ে হাসিমুখে পাসপোর্ট ফেরত দিলেন এই অফিসার।
কিংসটাউনে এর আগে বাংলাদেশ তিনটি টি-টোয়েন্টি খেলেছে। বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারলেও আয়ারল্যান্ড ও নেপালের বিপক্ষে জয় পেয়েছে তারা। পরিসংখ্যান জেনেই হয়তো অফিসার বাংলাদেশকে শুভকামনা জানিয়েছেন।
এদিকে ভারতীয় দম্পতি হেলেন ও রিউল থাকেন ফ্লোরিডাতে। ওখানে তারা চাকরি করতেন। এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। বুড়ো বয়সে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আত্মীর-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করাই হচ্ছে তাদের কাজ! এবার যেমন এসেছেন ছোট ভাই রনের সঙ্গে দেখা করতে। সেন্ট ভিনসেন্টে হেলেনের ভাই দীর্ঘদিন ধরেই বসবাস করেন। তার বাড়িতেই বেড়াতে এসেছেন হেলেন ও তার স্বামী রিউল। ভারতীয় এই দম্পতি ক্রিকেটের বেশ ভক্ত। ভারতে যাদের জন্ম, তারা ক্রিকেট ভক্ত না হয়ে উপায় কী? বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে রিউলের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো। এই আলাপ ছাড়িয়ে গেলো রাজনীতি পর্যন্ত। সাকিব-মাশরাফির খবরও জানা রিউলের। সাকিবের ভবিষ্যত নিয়েও জানার ভীষণ আগ্রহ তার। যতটুকু সম্ভব তার আগ্রহ মেটানোর চেষ্টা করলাম আমরা। সেন্ট ভিনসেন্টের কিংসটাউনে একটি ম্যাচ অন্তত দেখবেন বলে জানালেন। বিশেষ করে রিউল তো সুযোগ থাকলে তিনটি ম্যাচ দেখবেন বলে জানালেন।
এদিকে বোন ও বোনের জামাইকে নিতে বিমানবন্দরের কাছেই ছিলেন রন। তিনি সেন্ট ভিনসেন্টে নিজের অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। এখানে টুকটাক ব্যবসার পাশাপাশি নিজের বাগানে সময় দেন। বোনকে নিতে এসে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় রনের। এই শহর সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিলেন তিনি। জানালেন কোথায় কোথায় কী পাওয়া যায়! কীভাবে এই শহরে রাজত্ব করতে হবে?
সেন্ট ভিনসেন্টে পা ফেলার পরপরই রন-হেলেন-রিউলের মতো তিনজন মানুষের সান্নিধ্য পেয়ে ভুলেই গেলাম জার্নির ধকল। দারুণ আড্ডা শেষে আমাদের বিদায় নেওয়ার পালা। যাওয়ার আগে ভাইকে দেখিয়ে ভারতীয় নারী হেলেন বলে দিলেন, ‘যে কোনও প্রয়োজনে রনকে ফোন দিও।’
ভিনদেশে আমরা যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। ৯ দিনের এই সফরে বিপদের মুহূর্তে হয়তো পাশে কাউকে পাবো! এসব ভাবতে ভাবতেই আমাদের বুকিং করে রাখা কাসা ভিলা অ্যাপার্টমেন্টে পা ফেললাম।
শনিবার সকালে কাসা ভিলার বারান্দায় বসেই লিখছি এই লেখা। আমার সামনে নীল আকাশ। একটু আগে এখানে বৃষ্টি হয়েছে। বেশিক্ষণ থাকেনি সেই বৃষ্টি, তবে তার পরশে সামনের সবুজ যেন আরও গাঢ় হয়েছে। একটু দূরেই সাগর, সেখান থেকে ভেসে আসছে গর্জন। কাসা ভিলা থেকে খুব বেশি দূরে নয় কিংসটাউন। যেখানে আগামী সোমবার তিন ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ দল। ক্যারাবিয়ান দ্বীপ সেন্ট ভিনসেন্টের অপূর্ব নৈসর্গের সুধা পান করতে মুখিয়ে আছি আমরা। কিন্তু এই সুধা পানের চাবি এখন লিটন দাসদের হাতে! তাদের পারফরম্যান্স ভালো না হলেও অপূর্ব নৈসর্গের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যাবে!