উত্তর সিরিয়ার সামনের সারি ও আলাউইট পর্বতমালার ঘাঁটিগুলো থেকে সামরিক বাহিনীকে সরিয়ে নিচ্ছে রাশিয়া। তবে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পরও দেশটিতে তাদের দুটি প্রধান রুশ ঘাঁটি থেকে সেনা সরাচ্ছে না মস্কো। চার সিরীয় কর্মকর্তার বরাতে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এই খবর জানিয়েছে।
সিরিয়ায় রাশিয়ার দুটি ঘাঁটি রয়েছে: লাতাকিয়ার হামিমিম বিমানঘাঁটি ও টারতোস নৌঘাঁটি। প্রয়াত পিতা সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল আসাদের সঙ্গে মিলে মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা গড়ে তুলেছিলেন আসাদ। তবে বিদ্রোহীরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করায় দেশটিতে রাশিয়ার ঘাঁটিগুলোর ভবিষ্যত এখন প্রশ্নের মুখে।
শুক্রবারের (১৩ ডিসেম্বর) স্যাটেলাইট ফুটেজ দেখা যায়, বিশ্বের বৃহত্তম কার্গো উড়োজাহাজের মধ্যে অন্তত দুটি আন্তোনোভ এএ১২৪, হামিমিম ঘাঁটিতে দৃশ্যত লোড করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ঘাঁটিটির বাইরে অবস্থানরত একজন সিরীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) অন্তত একটি কার্গো বিমান লিবিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে।
রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এমন সিরিয়ার সামরিক ও নিরাপত্তা সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, মস্কো তার বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখভাগ থেকে প্রত্যাহার করছে। ইতোমধ্যে কিছু ভারী সরঞ্জাম ও সিরিয়ার সিনিয়র কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তবে রাশিয়া তার দুটি প্রধান ঘাঁটি থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে না এবং বর্তমানে এমনটি করার কোনও ইচ্ছাও নেই বলে জানিয়েছে সূত্র। পরিস্থিতির সংবেদনশীলতার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই তথ্য জানান তারা।
রুশ সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগকারী একজন সিনিয়র সিরীয় সেনা কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, কিছু সরঞ্জাম মস্কোতে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, সঙ্গে পাঠানো হচ্ছে আসাদের সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তাদেরও। এই পর্যায়ে এসে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার লক্ষ্য হচ্ছে, স্থলভাগের অগ্রগতি অনুসারে পুনরায় তাদের সংগঠিত করে মোতায়েন করা।
নতুন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ একজন সিনিয়র বিদ্রোহী কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতির বিষয়টি এবং আসাদ সরকার ও মস্কোর মধ্যে অতীতের চুক্তিগুলো নিয়ে কোনও আলোচনার হয়নি।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি ভবিষ্যৎ আলোচনার বিষয় এবং সিরিয়ার জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’ এসময় তিনি বলেন, মস্কো যোগাযোগের চ্যানেল স্থাপন করেছে।
বিস্তারিত কিছু না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বাহিনীও এখন লাতাকিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটির কাছাকাছি রয়েছে।’
ক্রেমলিন বলেছে, সিরিয়ার নতুন শাসকদের সঙ্গে ঘাঁটি নিয়ে আলোচনা করছে রাশিয়া। এই প্রতিবেদনের জন্য রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে রয়টার্স। তবে মন্তব্যের জন্য অনুরোধে সাড়া দেয়নি মন্ত্রণালয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি রুশ সূত্র জানিয়েছে, সিরিয়ার নতুন শাসকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং রাশিয়া তাদের ঘাঁটি থেকে সেনা সরাচ্ছে না।
সিরিয়ার বিদ্রোহী নেতা আহমেদ আল-শারা দেশটিতে রুশ ঘাঁটির দীর্ঘমেয়াদী ভবিষ্যত কীভাবে দেখেছিলেন তা তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি রয়টার্স। আল-শারা আবু মোহাম্মদ আল-গোলানি নামেও পরিচিত।
২০১৫ সালের সিরীয় গৃহযুদ্ধে পশ্চিমারা তখন আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানিয়েছিল তখন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের হস্তক্ষেপ সিরীয় প্রেসিডেন্টকে সাহায্য করেছিল। এমনকি গত রবিবারও মস্কো আসাদকে পালাতে সাহায্য করে এবং পরে তাকে রাশিয়ায় আশ্রয় দেয়।
ঘাঁটি
শীতল যুদ্ধের শুরু থেকেই সিরিয়াকে সমর্থন করেছে রাশিয়া। ১৯৪৪ সালে দামেস্ক যখন ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল তখন দেশটির স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল মস্কো। সিরিয়াকে দীর্ঘদিন ধরে সোভিয়েত উপগ্রহ বলে মনে করে আসছে পশ্চিমারা।
সিরিয়ার ঘাঁটিগুলো রাশিয়ার বৈশ্বিক সামরিক উপস্থিতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ: টারতোস নৌঘাঁটি রাশিয়ার একমাত্র ভূমধ্যসাগরীয় মেরামত ও সরবরাহ হাব। আর হামিমিম ঘাঁটিটি প্রধানত আফ্রিকায় সামরিক ও পোর্ট ভাড়া বিষয়ক কার্যকলাপের জন্য ব্যবহৃত হয়।
সিরীয় সামরিক ও পশ্চিমা গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সিরিয়ায় রাশিয়ার গোপন পোস্টও রয়েছে যেগুলো দেশটির সিগন্যাল স্টেশনের পাশাপাশি পরিচালনা করা হয়।
টারতোস ঘাঁটিটি ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আসাদের সহযোগিতায় রাশিয়া গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার পর, ২০১৭ সালে মস্কোকে ৪৯ বছরের জন্য বিনামূল্যে এটি লিজ প্রদান করে সিরিয়া।
ইস্তাম্বুলে অবস্থিত ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইওরুক ইসিক বসফরাস অবজার্ভার পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, রাশিয়া সম্ভবত সিরিয়ার বাইরে ককেশাস হয়ে কার্গো বিমান পাঠাচ্ছে এবং এর পর সেগুলো যাচ্ছে লিবিয়ার আল খাদিম বিমানঘাঁটিতে।
রয়টার্সের একজন সাংবাদিক বলেছেন, হামিমিম বিমান ঘাঁটির সঙ্গে টারতোস ঘাঁটির সংযোগকারী মহাসড়কে পদাতিক যুদ্ধের যানবাহন ও রসদবাহী যানবাহনের একটি রুশ গাড়ি বহরকে বিমান ঘাঁটির দিকে যেতে দেখা গেছে।
একটি গাড়িতে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় গাড়ি বহরটি পথে থামে। সেনারা যানবাহনের পাশে দাঁড়িয়ে সেটি মেরামত করছিল।
লাতাকিয়া থেকে ছেড়ে জাবলাতে বসবাসকারী আলি হালুম রয়টার্সকে বলেছেন, ‘রুশ, ইরানি বা পূর্ববর্তী সরকার যেই হোক না কেন, যারা আমাদের ওপর অত্যাচার করছে এবং আমাদের অধিকার অস্বীকার করেছে…আমরা রাশিয়া, ইরান বা অন্য কোন বিদেশি হস্তক্ষেপ চাই না।’
হামিমিম-এ রয়টার্স দেখেছে, রুশ সেনারা ঘাঁটির চারপাশে স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং হ্যাঙ্গারে জেট বিমান রয়েছে।
৯ ডিসেম্বরে তোলা প্ল্যানেট ল্যাবের উপগ্রহচিত্রে, টারতোসের ১৩ কিলোমিটার (৮ মাইল) উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত রাশিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় বহরে অন্তত তিনটি জাহাজ দেখা যায়। এর মধ্যে দুটি নির্দেশিত ক্ষেপণাস্ত্র ফ্রিগেট এবং অপরটি তেলবাহী।